পটভূমি
সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলার কোন লিখিত ইতিহাস নেই। লেখা হয়নি এর স্থানীয় বা আঞ্চলিক ইতিহাস। সে কারণে শাল্লা উপজেলার সার্বিক তথ্য উদ্ধার করে এর ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরে এ উপজেলা সম্পর্কে লেখা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। শাল্লা নিঃসন্দেহে একটি ইতিহাস বিশ্রুত জনপদ। এর বুকে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা সুপ্ত ও লুপ্ত হয়ে রয়েছে। এ অঞ্চল বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী হাওড়ের ভাঙ্গা-গড়া প্রাচীন ও নতুন চর নিয়ে গঠিত। তাই এর বয়স নির্ণয় করা খুবই কষ্টসাধ্য। বাংলাদেশের হাওড় বেষ্টিত এ উপজেলাটি ১৯১৯ খ্রিঃ নৌ-পুলিশ থানা, ১৯৪১ খ্রিঃ প্রশাসনিক থানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে কালনী নদীর প্রবল স্রোতের ভাঙ্গনে নৌ থানাটির অবকাঠামো নদীগর্ভে বিলুপ্ত হওয়ায় তখনকার বিজ্ঞজনেরা শাল্লা থানার মধ্যবর্তী স্থান হিসেবে ঘুঙ্গিয়ারগাঁও মৌজাকে বেঁছে নেন এবং এখানে থানাটি প্রতিষ্ঠিত করেন। সর্বশেষে ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে শাল্লাকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়।
এ উপজেলার নাম করণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন কিছু জানা যায়নি। তবে কথিত আছে, শাল্লার পূর্ব নাম ছিল শাহাগঞ্জ বাজার। শাহানুর নামে এক আউলিয়ার নামের উপর শাহাগঞ্জ বাজার প্রতিষ্ঠিত হয় বলে জনশ্রুতি আছে। জানা যায় শাহানুর নামে ঐ আউলিয়া সব সময় আল্লাহ আল্লাহ বলে জিকির করতেন এবং তাঁর নামের প্রথম অক্ষর শা এবং জিকিরের আল্লাহ উভয় মিলে শাল্লার নামকরণ হয়েছে বলে জনশ্রুতি আছে। অন্য একটি জনশ্রুতিতে জানা যায়, উক্ত এলাকাটি এক সময় কালীদহ সাগরের অংশ বিশেষ থাকার কারণে এ অঞ্চলে ক্রমান্বয়ে পলি ভরাটের ফলে মানুষের বসবাস শুরু হয়। পাশাপাশি এখানে মৎস্য আহরণের সুযোগ থাকায় জেলেদের বসতি গড়ে উঠে। জেলেরা পানিতে জাল ভেসে থাকার জন্য " সুলা " ব্যবহার করত। উক্ত " সুলা " শব্দ থেকে কালান্তরে শাল্লা নামকরণ করা হয়। শাল্লা একটি ভাটি অঞ্চল। এটি এক সময় বানিয়াচং পরগণার অধিনস্থ ছিল। এখানে মানুষের বসবাসের ইতিহাস সম্পর্কে সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে এ অঞ্চলের কিছু প্রাচীন নিদর্শন যেমন চবিবশা গ্রামে খলিশা হাটি ও বড় হাটি নামক স্থানের নাম থেকে বুঝা যায়, এখানে খাসিয়া উপজাতির বসবাস ছিল। এই সত্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে দেখা যায়, গ্রাম খলিশার পূর্ব প্রান্তে মাটির টেক/ঢিবি সহ অন্যান্য আরও কিছু সংখ্যক নিদর্শনে প্রমাণ করে এখানে উপজাতির বসবাস ছিল। সে হিসেবে এ অঞ্চলে মানুষের বসবাসের আনুমানিক বয়স প্রায় আটশত বছর পূর্বে।
সুনামগঞ্জ জেলা সদর থেকে ৬৫ কি.মি. দক্ষিণে দুর্গম হাওড় এলাকায় শাল্লা উপজেলার অবস্থান। বছরে প্রায় ৭ মাস এ অঞ্চল পানিতে নিমজ্জিত থাকে এবং অবশিষ্ট প্রায় ৫ মাস শুকনো মৌসুম। শুকনো মৌসুমে বিস্তীর্ণ হাওড় অঞ্চলে দেখা যায় সবুজ ধানের সমারোহ। আর বর্ষায় চারিদিকে থৈ থৈ পানি আর পানি, মাঝে মাঝে দেখা যায় হাওড় কন্যা গ্রামগুলো পানিতে ভাসছে। ধান উৎপাদন আর মৎস্য আহরণই এ অঞ্চলের মানুষের প্রধান উপজীব্য। এ অঞ্চলের কৃষি প্রধানত প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। প্রকৃতি সদয় হলে মানুষ ভাল ফসল পায়। আর প্রকৃতি বিরূপ হলে অনাবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, ঝড়-ঝঞ্ঝা, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢল ও অকাল বন্যায় চৈত্র-বৈশাখ মাসে কৃষকের ফসল নষ্ট হয়ে যায়। কেড়ে নেয় মানুষের মুখের গ্রাস, চারিদিকে নেমে আসে হাহাকার। বর্ষায় ঝড়ো হাওয়া, হাওড়ের পানির দুর্বার ঢেউ ভেঙ্গে দেয় মানুষের ঘর-বাড়ী, রাস্তা-ঘাট, গ্রাম-গঞ্জ। আর এভাবেই প্রকৃতির সঙ্গে নিরন্তর যুদ্ধ করে বেঁচে আছে এ উপজেলার মানুষ।
শাল্লা উপজেলার সীমানা উত্তরে দিরাই উপজেলা, পূর্বে হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলা, দক্ষিণে হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলা, দক্ষিণ-পশ্চিমে কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলা আর পশ্চিমে নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুড়ি উপজেলা। আর এর ভৌগলিক অবস্থান ২৪°৩৪' হতে ২৪°৪৯' উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১°০৮' হতে ৯১°২৩' পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস